দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন এক নতুন দৃশ্যের উদ্ভব ঘটেছে। দেখা যাচ্ছে, একজন সংসদ সদস্য (এমপি) প্রার্থী অন্য একজন এমপি প্রার্থীর প্রচারণায় নেমে পড়ছেন, আবার কেউ কেউ প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থীর সাফল্য কামনা করে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। বাইরে থেকে দেখলে এটি হয়তো প্রীতি ও সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত, কিন্তু ভেতরে লুকিয়ে আছে রাজনীতির ভয়াবহ অবক্ষয়। কারণ, যে পদটি একসময় ছিল নেতৃত্ব, ত্যাগ ও জনগণের আস্থার প্রতীক, সেই “এমপি” পদ এখন পরিণত হয়েছে তোষামোদী আর চাটুকারিতায়।
একসময় এমপি মানে ছিল রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন, দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং জনগণের কণ্ঠস্বর। কিন্তু বর্তমান সময়ে লক্ষ্য করা গেছে, অনেকেই এই গুরুত্বপূর্ণ পদটির মর্যাদা হারিয়ে ফেলছেন নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ও অবস্থান ধরে রাখতে না পারার কারণে। যার যার মতো করে প্রার্থী হয়ে যাচ্ছে। এই পদটির গুরুত্ব দিনদিন এমনভাবে তুচ্ছ করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে যোগ্যতম ও ব্যক্তিত্বশালীর এই পদে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। এমন সব প্রার্থীর প্রচারণা দেখে সাধারণ মানুষ হচ্ছে বিব্রত। একজন এমপি প্রার্থীকে নিয়ে চায়ের স্টলেও করছে ঠাট্টা মশকরা। মান আর মানহীন বলে কিছু নেই এখন। এমন এমপি প্রার্থীও রয়েছে, যারা আজ অন্য প্রার্থীর প্রচারণায় মিটিং মিছিলে ব্যস্ত, তারা আসলে নিজের যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতার ঘাটতি বুঝতে না পেরে তা নিজেরাই জনসম্মুখে প্রকাশ করে দিচ্ছেন। প্রশ্ন জাগে, যারা নিজের জনপ্রিয়তা প্রমাণে অক্ষম, তারা কিভাবে জনগণের নেতৃত্ব দেবেন আগামীদিনে?
রাজনীতি যদি হয় জনসেবা, তাহলে কেন, আমাদের দেশে এখন রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে পদের প্রতিযোগিতা। এক প্রার্থীর ব্যর্থতা মানে আরেকজনের আনন্দ এমনটাই চলে আসছিলো যুগযুগ ধরে। অথচ প্রকৃত নেতৃত্বের জায়গা হওয়া উচিত সহযোগিতা ও ইতিবাচক প্রতিযোগিতার। পদের প্রতিযোগিতা নয়।
বর্তমানে আমরা যে “প্রীতি-সম্প্রীতির রাজনীতি” দেখতে পাচ্ছি, তা মূলত সুবিধাভোগী ও প্রভাবকেন্দ্রিক মনোভাবের ফল। কেউ কারও প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন ভবিষ্যতে নিজের স্বার্থরক্ষার আশায়, আবার কেউ রাজনৈতিক লেনদেনের ফাঁদে পড়ে নিজের অবস্থান বিসর্জন দিচ্ছেন। আর ভবিষ্যতে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে সর্বদলীয় সুযোগ সন্ধানী হয়ে নিজের ব্যক্তিত্ব বিকিয়ে দিয়ে চাটুকারিতাকে বানিয়েছেন রাজনীতির একমাত্র পূঁজি।
আগের সময় যারা এমপি প্রার্থী হতো, সেই প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব, সামাজিকতা, আর্থিক স্বচ্ছলতা, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দক্ষতা, সবকিছু মিলে সাধারণ মানুষ ওই প্রার্থীদের গ্রহণ করত। ভোটাররা প্রার্থীর যোগ্যতা, নৈতিকতা এবং নেতৃত্বের ক্ষমতা যাচাই করতেন। কিন্তু আজকের দিনের পরিস্থিতি দেখলে মনে হয় এমপি পদকে শুধুই একটি রাজনৈতিক সুবিধা হিসেবে ধরা হচ্ছে। যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতার পরিবর্তে বেড়ে গেছে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও রাজনৈতিক চাটুকারিতার প্রাধান্যতা।
এ ধরনের “প্রীতি-সম্প্রীতি” মূলত স্বার্থপর মনোভাবের প্রতিফলন। একে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলা যায় না; বরং এটি এক প্রকার স্বার্থসিদ্ধির রূপ, যেখানে দলীয় নীতি বা জনগণের কল্যাণের চেয়ে ব্যক্তিগত সুবিধাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এটি শুধু নির্বাচনী প্রক্রিয়াকেই বিকৃত করছে না, বরং মানুষের রাজনীতির প্রতি বিশ্বাসও হ্রাস করছে। যখন ভোটাররা দেখতে পায়, প্রার্থীরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একে অপরের প্রচারণায় ব্যস্ত, তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা এবং উদাসীনতা বৃদ্ধি পায়।

আবার অনেকেই, যাদের ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার বা কোন দলীয় পদ বহন করার যোগ্যতা নেই, তারাও অনেকে বড় রড় রাজনৈতিক দলকে টেক্কা দিয়ে দল গঠন করতে মরিয়া হয়ে উঠছে। পাশাপাশি তারা দলীয় নিবন্ধন ও প্রতীক বরাদ্দ বরাদ্দের জন্য চেষ্টা তদবির করছেন নির্বাচন কমিশনে। একটি দলের নিবন্ধনের জন্য যেসকল শর্ত ও নিয়ম (মানদণ্ড) থাকা প্রয়োজন তা না থাকা সত্ত্বেও তারা তদবির, আন্দোলন, মিছিল ও অনশন করে চাপ ও সাধারণ মানুষের ইমোশনকে পঁজি করে নিবন্ধন পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
সামাজিক দায়িত্ব, নৈতিকতা ও ব্যক্তিত্বের জায়গায় এখন রাজনীতিতে চাটুকারিতা, সুবিধাবাদ, ইমোশন ও প্রভাবভিত্তিক সম্পর্ক প্রাধান্য পাচ্ছে। এমপি হওয়ার মানদণ্ডের পরিবর্তে ‘কার সঙ্গে কতটা প্রীতি’ বা ‘কতটা সুবিধা গ্রহণ করা সম্ভব’ এটাই এখন মূল পরিমাপক। এতে করে সাধারণ মানুষ এবং নতুন প্রজন্মের মধ্যে রাজনীতির প্রতি উৎসাহ হ্রাস পাচ্ছে। সংসদ সদস্য (এমপি) মানে, আইন প্রনেতা। ফলে, তাঁদের থাকতে হবে জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটসহ নানা বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান।
আমাদের প্রত্যাশা থাকা উচিত, এমপি পদ শুধুই একটি রাজনৈতিক সুবিধা বা স্বার্থসিদ্ধির মাধ্যম নয়। এটি জনগণের সেবা, ন্যায্য নেতৃত্ব এবং সমাজ উন্নয়নের প্রতীক হতে হবে। প্রার্থীদের উচিত হবে রাজনৈতিক প্রীতি এবং সহমর্মিতাকে কেবল ব্যক্তিগত সুবিধার হাতিয়ার হিসেবে না দেখে, সত্যিকারের নৈতিক রাজনীতির অংশ হিসেবে গ্রহণ করা। এতে করে সমাজে রাজনৈতিক বিশ্বাস ফিরে আসবে এবং নির্বাচন প্রক্রিয়া আবারও গণতান্ত্রিক ও গ্রহণযোগ্য হবে।
সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, আজকের দিনে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার প্রার্থী আর সংসদ সদস্য প্রার্থীর মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আচরণ, ভাষা, প্রচারণা সবখানেই মিল। যেমন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে যায়, ঠিক সেভাবেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিশ্রুতির পাহাড় গড়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে জনগণের জীবনে সেই প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন খুব কমই দেখা যায়।
যারা অহরহ প্রার্থী হচ্ছেন, তাদের উচিত সবার আগে নিজের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা নেয়া। তারপর বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যে, কোন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা তাঁদের জন্য সত্যিই প্রাসঙ্গিক এবং গ্রহণযোগ্য। নিজের অযোগ্যতার জন্য এই পদটিকে কলুষিত করা কারোরই জন্য শোভনীয় নয়।

এই প্রবণতা কেবল রাজনৈতিক শালীনতার অবক্ষয়ই ঘটাচ্ছে না, বরং রাজনীতিকে সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গা থেকেও দূরে ঠেলে দিচ্ছে। এখন অনেক তরুণ ভোটার রাজনীতিকে আর নেতৃত্ব বা আদর্শের জায়গা হিসেবে দেখেন না, বরং দেখেন এক ধরনের ক্ষমতার খেলা হিসেবে। এই রুচির দুর্ভিক্ষ অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বর্তমান বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যাবেনা কোনো ভাবেই।
রাজনীতিতে প্রীতি থাকা উচিত, সম্প্রীতি থাকা উচিত, কিন্তু তার সীমা পরিসীমা আছে। প্রীতির নামে আত্মসমর্পণ বা নিজের অবস্থান বিকিয়ে দেওয়া নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য নয়, বরং দুর্বলতার প্রকাশ। একজন প্রকৃত এমপি প্রার্থী কখনোই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীর পক্ষে কাজ করতে পারেন না, কারণ তা জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। জনগণ ভোট দেয় নেতৃত্বের আশা নিয়ে, নতজানু রাজনীতি ও স্বার্থন্বেষী নেতার জন্য নয়।
আমাদের এখন প্রয়োজন যোগ্য, আত্মবিশ্বাসী ও নীতিবান প্রার্থী, যারা রাজনীতিকে ব্যবসা বা পেশা নয়, সেবা হিসেবে দেখবেন। যারা নিজের অবস্থান ও মর্যাদা ধরে রেখে জনগণের পাশে দাঁড়াবেন, কেবল নির্বাচনের সময় নয়, সবসময় জনগণের পাশে থাকবেন।
রাজনীতি তখনই সুন্দর হয়, যখন প্রতিযোগিতা হয় নীতির, কর্মের ও আদর্শের ভিত্তিতে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, কে কার কাছে কতটা ঘনিষ্ঠ, কে কার সাথে মঞ্চ ভাগ করছে, এই বিষয়গুলোই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক অবক্ষয়ের কারণে রাজনীতির মান যেমন নিচে নামছে, তেমনি সংসদ সদস্য পদটিও হারাচ্ছে তার ঐতিহাসিক মর্যাদা। “এমপি প্রার্থী পদটি এখন হয়ে উঠছে খেলার মাঠ”। যে কেউ এখন নাম লিখাতে মরিয়া এই খেলায়।
শেষ পর্যন্ত, এসব কিছু নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে, আমরা কেমন রাজনীতি চাই? এমন রাজনীতি, যেখানে ব্যক্তিত্ব, নীতি ও আদর্শ মুখ্য থাকবে, নাকি এমন রাজনীতি, যেখানে “প্রীতি”র নামে প্রতিযোগিতা হবে চাটুকারিতা ও আত্মসমর্পণের? সময় এসেছে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার। কারণ রাজনীতি যদি মানুষ হারায়, তাহলে উন্নয়ন, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র, সবই হারাবে তাঁর আসল অর্থ ও উদ্দেশ্য।
সাংবাদিক ও লেখক : এম.আর রুবেল
সম্পাদক-নিউজ টুডে বিডি টুয়েন্টিফোর ডটকম।
